খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পরিবেশ সংরক্ষণ, এবং টেকসই নগর উন্নয়নের ক্ষেত্রে শহুরে কৃষি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাধান হয়ে উঠেছে। এই প্রসঙ্গে, কিউবার শহুরে কৃষি কার্যক্রম একটি শক্তিশালী উদাহরণ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কিউবা কঠিন অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়। সেই সংকট থেকে উত্তরণে দেশটি কৃষির মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনে বিপ্লব ঘটায়। আজ, কিউবার এই উদ্যোগ শুধু তাদের দেশেই নয়, বরং সারা বিশ্বের জন্যও অনুপ্রেরণার উৎস। এই প্রবন্ধে কিউবার শহুরে কৃষির উৎপত্তি, এর সাফল্য এবং এটি কীভাবে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য একটি আদর্শ হিসেবে কাজ করতে পারে তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কিউবার শহুরে কৃষির উত্থান ১৯৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে কিউবার অর্থনীতি এক গভীর সংকটের সম্মুখীন হয়, যা “স্পেশাল পিরিয়ড” নামে পরিচিত। কিউবা তাদের প্রধান বাণিজ্য অংশীদারের ক্ষতি এবং তেল, সার এবং খাদ্য আমদানিতে তীব্র ঘাটতির কারণে ব্যাপক খাদ্য সংকটের মধ্যে পড়ে। এই সংকটের সময়, কিউবার মানুষ ও সরকার নগর এলাকায় খাদ্য উৎপাদনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। শহরের অব্যবহৃত স্থান, ছাদ, এবং পরিত্যক্ত জমি ব্যবহার করে তারা খাদ্য উৎপাদন শুরু করে। এই উদ্যোগটি তাৎক্ষণিক সমস্যা সমাধান করলেও, সময়ের সাথে সাথে এটি একটি শক্তিশালী এবং টেকসই ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে ওঠে। কিউবার শহুরে কৃষির মূল বৈশিষ্ট্যকিউবার শহুরে কৃষি কার্যক্রম কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে সাফল্য অর্জন করেছে। ১. শহুরে স্থান ব্যবহারকিউবা শহুরে এলাকায় অনাবাদি জমি, স্কুলের খেলার মাঠ, এবং ছাদগুলোকে কৃষি উৎপাদনের জন্য কাজে লাগিয়েছে। বিশেষ করে, অর্গানোপোনিকোস নামে পরিচিত উঁচু বেড তৈরি করে জৈব মাটি ব্যবহার করে সবজি উৎপাদন করা হয়েছে। শহরের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এই পদ্ধতিতে উচ্চ ফলন নিশ্চিত করা হয়েছে। ২. জৈব পদ্ধতির ব্যবহারসার ও কীটনাশকের অভাবে কিউবা সম্পূর্ণ জৈব কৃষি পদ্ধতি গ্রহণ করে। কম্পোস্টিং, প্রাকৃতিক কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ, এবং ফসল চক্র পদ্ধতির মাধ্যমে তারা টেকসই খাদ্য উৎপাদনের একটি উদাহরণ স্থাপন করে। এই পদ্ধতিগুলো শুধু খাদ্য উৎপাদন বাড়ায়নি, মাটির স্বাস্থ্যও সংরক্ষণ করেছে। ৩. কমিউনিটি-কেন্দ্রিক উদ্যোগকিউবার শহুরে কৃষি কার্যক্রম স্থানীয় সম্প্রদায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণে পরিচালিত হয়। বাসিন্দারা নিজেরা বাগান পরিচালনা করে, খাদ্য উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত খাদ্য নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। এই উদ্যোগগুলি সমাজে ঐক্য এবং সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তোলে। ৪. সরকারের সহযোগিতা কিউবার সরকার শহুরে কৃষির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। জমি ব্যবহার সহজলভ্য করা, কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান, এবং কৃষি সরঞ্জাম বিতরণ সরকারের কয়েকটি উদ্যোগ ছিল। কেন্দ্রীয় খাদ্য ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীকরণ করে স্থানীয় উৎপাদনে জোর দেওয়া হয়েছে। ৫. গবেষণা ও শিক্ষাকিউবার কৃষি প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয় কৃষকদের সাথে একত্রে কাজ করেছে। তারা স্থানীয় চাহিদার ভিত্তিতে কৃষি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। উদ্ভিদের জাত উন্নয়ন, কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা এবং মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে এই গবেষণাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিউবার শহুরে কৃষির সাফল্য কিউবার শহুরে কৃষি কার্যক্রম খাদ্য উৎপাদন এবং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ১. খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকিউবার শহুরে কৃষি কার্যক্রম দেশের খাদ্য চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। ২০০৩ সাল নাগাদ, হাভানার শহুরে বাগানগুলো শহরের প্রায় ৯০% তাজা সবজির চাহিদা মেটায়। ২. অর্থনৈতিক উন্নয়নশহুরে কৃষি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে। পরিবহন এবং খাদ্য সংরক্ষণ খরচও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।৩. পরিবেশগত প্রভাবজৈব পদ্ধতির ব্যবহার পরিবেশ দূষণ কমিয়েছে এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সহায়ক হয়েছে। ৪. সামাজিক ক্ষমতায়নশহুরে কৃষি স্থানীয় জনগণকে তাদের খাদ্য চাহিদা পূরণে ক্ষমতায়িত করেছে। এটি সামাজিক বন্ধনকে শক্তিশালী করেছে এবং সংকট মোকাবেলায় স্থিতিশীলতা বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা বাংলাদেশের মতো দেশ, যেখানে দ্রুত নগরায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে, কিউবার শহুরে কৃষি একটি মূল্যবান উদাহরণ হতে পারে। বাংলাদেশের খাদ্য ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ১. ভূমির সীমাবদ্ধতা: ঢাকার মতো শহরে দ্রুত নগরায়নের কারণে চাষযোগ্য জমি দিন দিন কমছে। ২.পরিবহন নির্ভরতা:খাদ্য সরবরাহের জন্য দূরবর্তী গ্রামাঞ্চলের উপর নির্ভরশীলতা খাদ্যের ব্যয় বাড়ায়। ৩. জলবায়ু ঝুঁকি:বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে কৃষি উৎপাদন হুমকির মুখে পড়ে। সম্ভাব্য উদ্যোগ১. খালি জমির ব্যবহার:ঢাকা ও চট্টগ্রামের পরিত্যক্ত জমি ও ভবনের ছাদ শহুরে কৃষির জন্য কাজে লাগানো যেতে পারে। ২. ছাদ বাগান:শহরের বাড়িগুলোর ছাদে সবজি চাষ জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। ৩. জৈব পদ্ধতি: নগর কৃষিতে কম্পোস্ট এবং জৈব সার ব্যবহার করে টেকসই উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশে কিউবার মডেলের বাস্তবায়ন কিউবার মডেল অনুসরণ করে বাংলাদেশের শহুরে কৃষি কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে: ১. সরকারি সহযোগিতাসরকারকে শহুরে কৃষি উন্নয়নে ভূমিকা নিতে হবে। শহুরে কৃষকদের প্রশিক্ষণ, যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। ২. পাইলট প্রকল্পঢাকার নির্দিষ্ট এলাকায় একটি পাইলট প্রকল্প চালু করে শহুরে কৃষির সম্ভাবনা মূল্যায়ন করা যেতে পারে। সফল হলে, এই মডেল দেশের অন্যান্য শহরে প্রয়োগ করা সম্ভব। ৩. শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধিস্থানীয় স্কুল, কলেজ এবং কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে কৃষি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এটি শুধু খাদ্য উৎপাদনে সহায়তা করবে না, বরং নতুন প্রজন্মকে পরিবেশ রক্ষায় অনুপ্রাণিত করবে। ৪. সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্ব (PPP)সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে শহুরে কৃষির প্রচলন সম্ভব। ৫. গবেষণা ও উদ্ভাবনবাংলাদেশের মাটি, জলবায়ু, এবং চাষযোগ্য ফসলের উপযোগিতা যাচাই করে গবেষণা চালানো প্রয়োজন।— কিউবার শহুরে কৃষি কার্যক্রম খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার একটি অনন্য উদাহরণ। এটি শুধু খাদ্য উৎপাদনে সহায়ক নয়, বরং পরিবেশ রক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক স্থিতিশীলতায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের মতো দেশ, যেখানে খাদ্য নিরাপত্তা একটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয়, কিউবার উদাহরণ অনুসরণ করে স্থানীয় পরিস্থিতির সঙ্গে মিল রেখে শহুরে কৃষি উন্নয়ন সম্ভব। সময় এসেছে বাংলাদেশের শহরগুলোতে খাদ্য উৎপাদনে বিপ্লব ঘটানোর। কিউবার পথ অনুসরণ করে, শহুরে কৃষি আমাদের ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তার ভিত্তি স্থাপন করতে পারে। REFERENCES: 1.https://www.researchgate.net/publication/226603269_The_Greening_of_the_’Barrios’_Urban_Agriculture_for_Food_Security_in_Cuba 2.https://www.architectural-review.com/essays/cubas-urban-farming-revolution-how-to-create-self-sufficient-cities 3.https://monthlyreview.org/2013/03/01/cuban-urban-agriculture-as-a-strategy-for-food-sovereignty/ 4.https://www.landscapeinstitute.org/blog/urbanagriculture_parttwo/