বাংলাদেশ—একটি নদীমাতৃক দেশ, যেখানে জলের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক হাজার বছরের পুরনো। এই সম্পর্ক কখনও জীবনধারণের, আবার কখনও সংগ্রামের। বন্যা, যা অনেকের কাছে শুধুই একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বাংলাদেশের লাখো মানুষের জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। এখানে জলের সঙ্গে বসবাস করার যে সাহসিকতা আর অভিযোজনের গল্প আছে, তা আমাদের জন্য এক অনুপ্রেরণা।
বাংলাদেশের বন্যার প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম বন্যাপ্রবণ দেশ। প্রতি বছর বর্ষাকালে দেশের প্রায় ২০-৩০% অঞ্চল বন্যার কবলে পড়ে। তবে বড় ধরনের বন্যার সময় এই সংখ্যা ৬০-৭০% পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে (সূত্র: বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড)। প্রধানত দেশের নদীগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা, হিমালয় থেকে আসা বরফগলা পানি, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব—সব মিলিয়ে বন্যা বাংলাদেশের একটি বার্ষিক বাস্তবতা।
জলের সঙ্গে অভিযোজন: কিশোরগঞ্জের হাসিনা বেগমের গল্প
হাসিনা বেগম, কিশোরগঞ্জ জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা। তার পুরো জীবনটাই নদীর জলে ঘেরা। নদীর ধারে ধান চাষ আর মাছ ধরা তাদের পরিবারের প্রধান জীবিকা। প্রতি বছর বন্যার সময় তাদের গ্রাম পুরোপুরি জলের নিচে চলে যায়। কিন্তু এটাই তাদের জন্য নতুন কিছু নয়।
হাসিনা বলেন,
“বন্যা আমাদের জীবন বাধাগ্রস্ত করলেও, এটি আমাদের নতুনভাবে শুরু করার শক্তি দেয়। আমরা জানি কিভাবে জলের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়।”
হাসিনা বেগম তার বাড়ির মাচা উঁচু করে তৈরি করেছেন, যা বন্যার সময় তাকে আশ্রয় দেয়। তার মত অনেক পরিবারই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বন্যার পানি থেকে বাঁচার চেষ্টা করে।
বন্যার অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রভাব
বাংলাদেশের জিডিপি’র একটি বড় অংশ কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীল। বন্যার ফলে ফসল ধ্বংস হওয়া, জমি ক্ষয়, এবং রাস্তা ও অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া দেশটির অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।
- ২০২০ সালের বন্যায় প্রায় ৫.৪ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে (সূত্র: UNDP)।
- প্রায় ৪.৭ মিলিয়ন মানুষ তাদের বাড়িঘর হারিয়েছে।
তবে বন্যার একটি ইতিবাচক দিকও আছে। বন্যার পানি মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে, যা কৃষির জন্য উপকারী। কিন্তু এটির সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকলে বন্যা দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠে।
স্থানীয় জ্ঞান ও প্রযুক্তি
বাংলাদেশের মানুষ শত শত বছর ধরে স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে বন্যার সঙ্গে লড়াই করে আসছে।
ভাসমান চাষাবাদ (Floating Agriculture):
বন্যাপ্রবণ এলাকায় মানুষ ভাসমান মাচার ওপর সবজি এবং ধান চাষ করে। এই প্রযুক্তি এখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত।উঁচু মাচার ঘর:
অনেক পরিবার তাদের বাড়ি উঁচু করে তৈরি করে, যা বন্যার সময়ও নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে কাজ করে।নৌকা-ভিত্তিক জীবনধারা:
বরিশাল এবং পটুয়াখালীর মতো এলাকায় নৌকাই মানুষের প্রধান যানবাহন। বন্যার সময় এটি জীবন রক্ষার অন্যতম মাধ্যম।
বন্যার সঙ্গে অভিযোজন: বিশ্ব থেকে শেখা
বিশ্বের অন্যান্য বন্যাপ্রবণ দেশ যেমন নেদারল্যান্ডস তাদের “Room for the River” প্রকল্পের মাধ্যমে বন্যা ব্যবস্থাপনার একটি টেকসই মডেল তৈরি করেছে। তারা নদীর তীর এলাকাগুলো খালি রেখে সেখানে জলাধার এবং সবুজ এলাকা তৈরি করেছে।
বাংলাদেশেও এই ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের নদীভাঙন এলাকা এবং জলাভূমিগুলো টেকসই ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা হলে বন্যার প্রভাব অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
শিক্ষা ও সচেতনতার গুরুত্ব
বন্যার সময় সঠিক পরিকল্পনা এবং সচেতনতার অভাব অনেক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
- গ্রামের মানুষদের জন্য দুর্যোগ প্রস্তুতি শেখানো প্রয়োজন।
- স্কুলের পাঠ্যক্রমে বন্যা ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
- স্থানীয় প্রশাসন এবং এনজিওগুলোকে আরও সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশের মানুষদের বন্যার সঙ্গে অভিযোজনের গল্প কেবল লড়াইয়ের নয়, এটি টিকে থাকার, নতুন উদ্ভাবনের, এবং একে আশীর্বাদে পরিণত করার গল্প। জলের সঙ্গে এই অভিযোজনের চর্চা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং বিশ্ববাসীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার উদাহরণ।
“জল আমাদের শত্রু নয়। আমরা জানি কিভাবে এটির সঙ্গে বসবাস করতে হয়। এটি আমাদের জীবন।”
এই ধরনের সাহসিকতা এবং উদ্ভাবনী কৌশল থেকে বিশ্ব অনেক কিছু শিখতে পারে। বাংলাদেশের এই গল্পগুলো আমাদের আরও সচেতন এবং স্থিতিস্থাপক হতে উদ্বুদ্ধ করে।