নদী দখল এবং দূষণ: বাংলাদেশের বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি ও সমাধানের উপায়
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হলেও আজ নদীগুলো অস্তিত্ব সংকটে। দখল, দূষণ এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে দেশের নদীগুলোর প্রাকৃতিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নদীগুলোর সংকট শুধু পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর নয়, বরং দেশের বন্যার প্রকোপও বাড়িয়ে তুলছে। নদী দখল এবং দূষণের এই সমস্যা যদি অব্যাহত থাকে, তবে বাংলাদেশ একটি গভীর পরিবেশগত সংকটের সম্মুখীন হবে।
নদী দখল এবং দূষণের বর্তমান অবস্থা
১. নদী দখল:
- ঢাকার চারপাশে থাকা ৬৫টি খালের প্রায় ৭০% দখল হয়ে গেছে (সূত্র: বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড)।
- বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা এবং তুরাগ নদী দখল এবং ভরাটের কারণে তাদের প্রস্থ ও গভীরতা হারিয়েছে।
২. নদী দূষণ:
- শিল্প বর্জ্য, গৃহস্থালির বর্জ্য, এবং প্লাস্টিকের কারণে দেশের নদীগুলো মারাত্মকভাবে দূষিত।
- বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রতি বছর প্রায় ২২ লাখ কিউবিক মিটার শিল্প বর্জ্য ফেলা হয় (সূত্র: পরিবেশ অধিদপ্তর)।
৩. নদীর প্রভাব হারানো:
- দখল এবং দূষণের কারণে নদীগুলোর প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশনের ক্ষমতা কমে গেছে, যা বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
নদী দখল এবং দূষণের কারণে বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি
১. প্রাকৃতিক প্রবাহ ব্যাহত:
- দখল এবং ভরাটের কারণে নদীগুলো তাদের প্রাকৃতিক প্রবাহ হারিয়েছে।
- বৃষ্টির পানি বা পাহাড়ি ঢল সহজে নদীর মাধ্যমে বের হতে পারে না, ফলে বন্যা বৃদ্ধি পায়।
২. শহরে জলাবদ্ধতা:
- ঢাকার খালগুলোর দখল এবং দূষণের কারণে শহরে বৃষ্টির সময় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।
- ২০২১ সালে ঢাকায় মাত্র ২ ঘণ্টার বৃষ্টিতে প্রায় ৫০% রাস্তা ডুবে গিয়েছিল।
৩. নদীভাঙন:
- দখল এবং অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের ফলে নদীর গতিপথ বদলে যাচ্ছে, যা নদীভাঙনের ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
৪. পরিবেশগত ক্ষতি:
- দূষণের কারণে নদীর পানি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে, যা কৃষি, মৎস্য, এবং মানুষের স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
নদী সংরক্ষণে চ্যালেঞ্জ
১. আইনের প্রয়োগের অভাব:
- নদী রক্ষা আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় দখল এবং দূষণ অব্যাহত রয়েছে।
- ২০১৯ সালে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন নদী দখলকারীদের বিরুদ্ধে প্রায় ১০০টি মামলা করলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
২. স্থানীয় সচেতনতার অভাব:
- অনেক মানুষ নদীর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন নয়।
- প্লাস্টিক এবং বর্জ্য নদীতে ফেলার প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে।
৩. অবকাঠামোগত সমস্যা:
- নদীর প্রবাহ বজায় রাখতে ড্রেজিং এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাব রয়েছে।
৪. শিল্প প্রতিষ্ঠানের অসচেতনতা:
- অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান তাদের বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ না করে সরাসরি নদীতে ফেলে।
নদী সংরক্ষণে করণীয়
১. দখলমুক্ত করা:
- দখল হওয়া নদীগুলো পুনরুদ্ধার এবং দখলকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ।
- ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো শহরের নদী এবং খালগুলো পুনরুদ্ধারে বিশেষ প্রকল্প চালু।
২. দূষণ নিয়ন্ত্রণ:
- শিল্প বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ বাধ্যতামূলক করা।
- গৃহস্থালি এবং প্লাস্টিক বর্জ্যের জন্য আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা চালু।
৩. স্থানীয় জনগণকে সচেতন করা:
- স্কুল এবং কলেজ পর্যায়ে পরিবেশ শিক্ষা চালু।
- স্থানীয় জনগণকে নদীর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে ক্যাম্পেইন।
৪. টেকসই উন্নয়ন প্রকল্প:
- ড্রেজিং প্রকল্পের মাধ্যমে নদীর গভীরতা এবং প্রবাহ পুনরুদ্ধার।
- নদীর তীর সংরক্ষণে সবুজ বেষ্টনী তৈরি।
৫. প্রযুক্তির ব্যবহার:
- উপগ্রহের মাধ্যমে নদীর দখল এবং দূষণের ওপর নজরদারি।
- স্মার্ট সেন্সর ব্যবহার করে নদীর দূষণের মাত্রা পরিমাপ।
বিশ্ব থেকে শিক্ষণীয় উদাহরণ
১. নেদারল্যান্ডসের “Room for the River” প্রকল্প:
- নেদারল্যান্ডস তাদের নদীগুলোর প্রাকৃতিক প্রবাহ বজায় রাখতে তীর সংলগ্ন এলাকাগুলো খালি রাখে।
- বাংলাদেশে এই মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে।
২. জাপানের নদী ব্যবস্থাপনা:
- জাপান তাদের নদী দূষণ প্রতিরোধে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করেছে।
৩. সিঙ্গাপুরের “Active, Beautiful, Clean Waters” প্রোগ্রাম:
- সিঙ্গাপুরের মতো বাংলাদেশের শহরগুলোতেও খালের সৌন্দর্যায়ন এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণে এই মডেল প্রয়োগ করা যেতে পারে।
নদী দখল এবং দূষণ বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এটি শুধু বন্যার প্রকোপ বাড়াচ্ছে না, বরং পরিবেশ এবং অর্থনীতির ওপরও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলছে।
নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ পুনরুদ্ধার এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে পারে। এটি শুধু দেশের জন্য নয়, বরং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি দায়িত্ব। এখনই সময় নদী সংরক্ষণের দিকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার।